রাজনীতিতে নারীঃ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ

আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেলঃ
সারা বিশ্বের অন্যন্য অঞ্চলের নারীদের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় নারীরা রাজনীতিতে ভালোভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অংসাচ সূচী,শেখ হাসিনা,খালেদা জিয়া কিংবা অন্য কোন নারী নেত্রী নারীদের শীর্ষত্ব বহন করলেও গবেষণায় দেখা যায়, এ অঞ্চলের বেশীর ভাগ নারীরা সামাজিক ও ধর্মীয় কিংবা পুরুষতান্ত্রিকতার কারনে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ একেবারেই কম। পেশিশক্তির অপব্যবহার, কালো টাকার দাপট, প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মানসিকতা নারীকে রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। সবখানে পুরুষের একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক পরিম-লে পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রতাপ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। ধর্মীয় মৌলবাদ এ অঞ্চলের রাজনীতিতে এক নতুন প্রভাবক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জেন্ডারভিত্তিক শ্রম বিভাজনের মধ্য দিয়ে নারীর জন্য এমন সব কাজ নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলোয় হৃদয়ের নিবিড় ছোঁয়া যুক্ত থাকলেও তার তেমন কোনো সামাজিক মূল্য নেই। প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এসব কাজকে অসার বা মূল্যহীন বলে বিবেচনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তুচ্ছ করে দেখা হয়। এই সামাজিক ব্যবস্থা বা আচরণ পিতৃতান্ত্রিকতাকেই আরো শক্ত-পোক্ত করে তোলে। পরিণতিতে নারীরা আরো বেশি বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হন। এর ফলে সমাজে নারীরা মর্যাদা ভোগ করতে পারেন না। চাকরির ক্ষেত্রে তারা পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার ভোগের সুযোগ পান না। তুচ্ছ কারণে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরির ক্ষেত্রে নারীরা সব সময়ই এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। সমাজে নারীর জন্য সবচেয়ে কম মজুরির ও কম মর্যাদার কাজগুলোই বরাদ্দ রাখা হয়। এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য প্রকট। একই কাজের জন্য নারীর তুলনায় পুরুষ অধিক মজুরি পান। সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রেও নারী ভীষণভাবে বঞ্চিত।
পৃথিবীতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরাই দরিদ্রতম এবং তাদের সংখ্যা প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ। পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ১ ভাগের মালিক নারীরা।এটি হচ্ছে বৈষম্য টিকিয়ে রাখা এবং নারীকে শোষণ করার এক হাতিয়ার। সংস্কৃতির অনেক উপাদানই নারীর অবাধ চলাচল, উত্তরাধিকার বা সম্পত্তিতে অধিকার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে। পুরুষের আধিপত্যবাদী মানসিকতা ও নিয়ন্ত্রণের সংস্কৃতির কারণে নারীদের বিভিন্ন রকম হয়রানি, বৈষম্য, শোষণ ও বিভিন্ন রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন, যেমন স্ত্রী নির্যাতন, বেশি মাত্রায় কাজ চাপিয়ে দিয়ে কম খাদ্য গ্রহণের মতো আপত্তিকর ও ক্ষতিকর প্রথাগত আচরণের চর্চা করা হয়; যা মেয়েশিশু ও নারীর জীবন এবং স্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় (পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ) প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একশ্রেণির মানুষকে বঞ্চিত করে রাখা ও উপেক্ষা দেখানোর প্রবণতা আছে, যা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আরো স্পষ্টভাবে বললে নারীর অধিকারকেই অস্বীকার করা।
পুত্রসন্তানের প্রতি বিশেষ আকাঙ্ক্ষার সংস্কৃতির কারণে ভ্রূণাবস্থা থেকেই নারী বৈষম্যের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় জন্মের পরে, শৈশবে এবং এরই ধারাবাহিকতায় বিয়ের পর, গর্ভধারণকালে ও সন্তান জন্মদানের সময় নারীর স্বাস্থ্যের বিষয়টি ভীষণভাবে উপেক্ষিত হয়। ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুর মৃত্যুহার এ অঞ্চলজুড়েই অনেক বেশি। অপুষ্টি, সন্তান জন্মের সময় মৃত্যু, গর্ভকালীন নির্যাতন ও সহিংসতার উচ্চহার ইত্যাদি সূচক এ কথাই প্রমাণ করে যে এ অঞ্চলে নারীর প্রজননস্বাস্থ্যের বিষয়টি উপেক্ষিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় সঠিক পরিমাণে খাদ্য ও পুষ্টির অভাব এবং সময়মতো চিকিৎসাসেবা গ্রহণ না করার ফলে নারী অধিক হারে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এর মধ্যে ১ বছর কম বয়স থেকে শুরু করে ১৫-১৯ বছরের বেশি বয়সীরাও আছে। এ অঞ্চলের মেয়েদের একটি সাধারণ সমস্যা হচ্ছে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা। প্রায় সব বয়সী মেয়ের মধ্যেই এ সমস্যা দেখা যায়। নারীরা প্রায়ই পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বহীন সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে তারা জীবনের প্রথম ভাগ থেকেই খাদ্য-পুষ্টি-চিকিৎসার ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।
পারিবারিক নির্যাতন দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক প্রচলিত সমস্যা, প্রতিটি দেশে ৭০ শতাংশের ওপর নারী পারিবারিকভাবে সহিংসতার শিকার হয় শারীরিক ও মানসিক। নারী নির্যাতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যৌতুক। এ প্রথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বিশেষ করে ভারতের সমাজে একটি অলিখিত প্রথায় পরিণত হয়েছে। যৌতুকের কারণে স্ত্রী অর্থাৎ কনেপক্ষ অন্য পক্ষ দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। যৌতুকের কারণে কখনো নির্যাতনের মাত্রা হত্যা পর্যন্ত গড়ায় এবং আত্মহত্যার প্ররোচনা জোগায়। ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী যৌতুকের কারণে ৮ হাজার ৬১৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে।
নারীর প্রতি সহিংসতার আরেক নির্মম রূপ হলো ফতোয়া। মূলত নারীর প্রতি অসমতার দৃষ্টিভঙ্গির একটি অন্যতম প্রধান কারণ মৌলবাদ।মৌলবাদ নারীর অগ্রযাত্রার তথা নারীর অধিকার সংরক্ষণের প্রধান বাধা।সামাজিক পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কারণে পিছিয়ে পড়া অংশের দুর্বলতার সুযোগ নেয় মৌলবাদীরা, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এবং সমাজচ্যুত করা, পাথর ছোড়া, দোররা মারা, ঘরবন্দি করে রাখা ইত্যাদি শাস্তি দেয়া হয় নারীকে। অপহরণ এ অঞ্চলের নারীদের জন্য আরেক খ্তগ। বিশেষ করে সীমান্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে, যেখানে ভৌগোলিক অবস্থান, যোগাযোগব্যবস্থা এ অপরাধ সংঘটনকে সহজ করে তোলে এবং অপহরণের পর ধর্ষণ, নির্যাতন, মৃত্যু হয় নারীর শেষ পরিণতি।
নারী ও শিশু পাচার এ অঞ্চলের নারীদের জন্য বিশেষ আতঙ্কের কারণ। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী এবং কন্যাশিশু (কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুত্রশিশুও) জীবিকার প্রয়োজনে যখন নানা ধরনের কাজের সন্ধানে নামে, তখন তারা পাচারের শিকারে পরিণত হয়। পরে তাদের বাধ্য করা হয় নানারকম অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হতে। জোরপূর্বক গর্ভপাত, যৌনকাজে লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি ধরনের অপরাধ কখনো কখনো বিচ্ছিন্ন বিসয় হিসেবে পরিগণিত এবং আলোচিত হয়। নারী সবার পরে খান এবং সবচেয়ে কম খান, তা-ও যদি তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে। দারিদ্র্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীরা অভুক্ত থাকেন। আর সে কারণেই মেয়েশিশুর মৃত্যুহার বেশি। তাছাড়া নারীদের চাওয়া পাওয়া সবসময়ই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পায়না। যদিও পায় তা হতে হয় পুরুষের চাহিদা মেটানোর প্রেক্ষিত। স্বাধীনভাবে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা রাজণীতিতে অংশগ্রহণ দূর্লভ ঘটনার মত। শিশুরা তাদের মতো করে বড় হয়না। পরিবারের মতো করে বড় হতে হয় । তাই নারী শিশুরা পিছিয়ে থাকে বরাবরের মত। কিšতু এ পিছিয়ে থাকার মানসিকতাও কম দায়ী নয় । তাই নারীদের আজ জাগতে হবে। নারীদেরকে তাদের মতো করে সংগ্রামী চেতনায় বেচে থাকার মানসিকতা অর্জন করতে হবে । তবেই নারীর আসল মুক্তি। নারী মুক্তি উগ্রতায় নয়। আসল মুক্তি তাদের অধিকার রক্ষার চেতনার মাঝে। এই সত্যটা আজ নারীদের ভাল ভাবে বোঝা উচিত।
লেখক-
আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেল
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন
( একটি ফেসবুক ভিত্তিক নারী অধিকার আন্দোলন)