আতিকুল্লাহ আরেফিন রাসেল
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান,গ্রামে চল আন্দোলন
(প্রকাশিত- ক্রাইম ডায়রি মার্চ ২ সংখ্যা /কপিরাইট 2016/সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত/কপি করা আইনগত অপরাধ।/দৃষ্টিগোচর হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।)
একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য ২৫ভাগ বনভুমি প্রয়োজন । ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে বনভ’মি ছিল ১৬ ভাগ। নব্বইয়ের দশকে যা নেমে এসেছিল ৯ ভাগ। এখন কয় ভাগ বনভুমি তা না হয় নাই বললাম। বন আমাদের কতটুকু প্রয়োজন। তা সিডর দিয়ে অনেকেই বুঝেছেন আশা করি। সুন্দরবন না থাকলে এ দেশের কি অবস্থা হতো তা ঐ অঞ্চলের মানুষ হারে হারে বুঝতে পেরেছে। রোগ শোক মুক্ত,দারিদ্রতামুক্ত, প্রাকৃতিক বিপর্যয়মুক্ত এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কারনে মানুষের আতœরক্ষা বিভিন্ন প্রয়োজনে কিংবা সুখী সম্মৃদ্ধ জীবন যাপনের জন্য বণের ভ’মিকা অনস্বীকার্য।
মানুষকে বাঁচতে হলে যেমন প্রয়োজন পরিবেশ, তেমনি একটি পরিবেশ টিকে থাকার জন্যও দরকার বনভূমি। আর সেই বনভূমিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। বনভূমি টিকে থাকলে আমাদের পরিবেশ টিকে থাকবে। পরিবেশ ঠিক থাকলে আমরাও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকব। বন-বনানীর ভূমিকার কথা স্বীকার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছরর্ বিশ্ব বনদিবস পালন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এ দিবসের কথা অনেকেই হয়তো জানেন না। তবে এ সচেতনতা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বাড়িয়ে তোলার জন্যই এ রকম একটি দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে সামাজিক বনায়নের গুরুত্ব সবার কাছে তুলে ধরতে হবে। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনে সামাজিক বনায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা নতুন করে কিছুই বলার নেই।
সামাজিক বনায়ন হলো এমন ব্যবস্থাপনা— কর্মকাণ্ড, যার সঙ্গে পল্লীবাসী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নিবিড় সম্পর্কযুক্ত। তাই বনায়নে স্থানীয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া বন সংরক্ষণ সম্ভব নয়। সুতরাং পল্লীবাসীর প্রয়োজনকে বিবেচনায় রেখে বনায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ পল্লীবাসীরা জীবন রক্ষার প্রয়োজনেই গাছ কাটে। তবে তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয় এবং একটি গাছ কাটলে সঙ্গে সঙ্গে এক বা একাধিক গাছ লাগানোর প্রচেষ্টাও যেন তাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকে এমন সচেতনতা তাদের মধ্যে রোপণ করে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে বন যেমন আমাদের ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে তেমনি বনের কাঠ শুকিয়ে গেলে তা দিয়ে আমাদের অর্থের জোগান হয়ে থাকে। এছাড়াও বনভূমি থেকে আমরা অনেক সুফল লাভ করি।
১৯৯২ সালে রিও ঘোষণায় বনসৃজন ও রক্ষার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও সারা পৃথিবীতে উজাড় হয়েছে বাংলাদেশের সমান আয়তনের ২০টি বনভূমি। আমাদের মতো ছোট্ট একটি দেশেও প্রয়োজনের তুলনায় বনভূমির আয়তন অনেক কম। জীবনের প্রয়োজনে বনভূমির পরিমাণ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। আজ আমরা সেই বনভূমি সাময়িক সুখ-শান্তির জন্য এবং অর্থের জন্য কেটে উজাড় করে দিচ্ছি। গাছ শুধু বিশুদ্ধ অক্সিজেনের মাধ্যমেই আমাদের জীবনই রক্ষা করে না, একইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে আমাদের রক্ষা করতেও ঢাল হিসেবে কাজ করে। এর প্রমাণ ২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বরের সিডর। স্মরণকালের এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক ঝড়ের আঘাত থেকে বাংলাদেশকে আরো বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল সুন্দরবনের বনাঞ্চল। সুন্দরবন না থাকলে হয়তো উপকূল একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। সুন্দরবনের বনাঞ্চল ঝড়ো-হাওয়ার একেকটি আঘাত বুক পেতে না ঠেকালে দক্ষিণাঞ্চলের মতো অনেক জেলা বিরানভূমিতে পরিণত হতো।
জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বনের গুরুত্ব অপরিহার্য। বন ছাড়া জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব টিকে রাখতে পারে না। পৃথিবীতে যা কিছু আছে তাকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা হলে জীব জগত্ ও প্রাণী জগেকই বোঝাবে। জীববৈচিত্র্য হচ্ছে প্রকৃতির সন্তান। উদ্ভিদ ও প্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যের একমাত্র আশ্রয়স্থল হচ্ছে বন। বন মহাকালের সৃষ্টি, এতে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে জীববৈচিত্র্য আজ বিলুপ্তির পথে। বন সুরক্ষায় ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন করে আসছে। বিশ্বব্যাপী শিল্প বিপ্লবের পর থেকে পরিবেশ দূষণ শুরু হয়। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের কারণে পৃথিবী বসবাসের বিপদমুখী হচ্ছে প্রাণীকূল। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। কিন্তু আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বের মোট ভূমির পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার মিলিয়ন হেক্টর। মোট ভূমির ৭৮ ভাগ চাষাবাদের অনুপযোগী, ২২ ভাগ ভূমি চাষাবাদযোগ্য। ২০০ বছর আগেও বিশ্বের ৪৭ ভাগ এলাকা বনভূমিতে পরিবেষ্টিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ২৯ ভাগ এলাকা বনভূমি রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ রয়েছে ১৭.৪ ভাগ। দেশের মোট আয়তন ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯৩ বর্গ কি. মি.। এর মধ্যে বনাঞ্চল ২৩ হাজার ৯৯৮ বর্গ কি. মি.। জনসংখ্যা চাহিদার তুলনায় বনভূমির পরিমাণ খুবই কম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছড়ানো-ছিটানো যে অল্প বনভূমি রয়েছে তাও মানুষ নির্বিচারে কেটে সাবাড় করছে। দেশের মানুষের কাঠ ও জ্বালানি কাঠের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে গিয়ে বনভূমি দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা পৃথিবী থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটে পৃথিবী থেকে ১৯০ একর বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের প্রয়োজনে পরিবেশ তথা বন ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ১০০টির বেশি দেশ মরুময়তার শিকার। ড্রাইল্যান্ডের ৭০ ভাগ ভূমি আজ বন হারিয়ে যাওয়ায় মরুময়তায় চলে যাচ্ছে। এর আয়তন প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন হেক্টর। এশিয়ার প্রায় মিলিয়ন হেক্টর জমি মরু বিস্তারের সম্মুখীন। অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশে প্রায় ২.৬ মিলিয়ন বর্গ কি.মি. মরুভূমির সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিবছর এ মরুভূমির ৩-৪ কি. মি. করে বাড়ছে। ভারতের থর মরুভূমি প্রতি বছর প্রায় ১ কি. মি. বাড়ছে। মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীর ১০ ভাগ বন ও তৃণভূমি মরুময়তার শিকার হচ্ছে, আর ২৫ ভাগ হুমকির সম্মুখীন। প্রতি মিনিটে মরুভূমি গ্রাস করছে ৪৪ হেক্টর উর্বর জমি এবং ২০ হেক্টর বনভূমি বিরান হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বন উজাড়ের ফলে মরুময়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা মানুষ হলেও আমাদের এখনও সচেতনতার অভাব রয়েছে। এদেশের মানুষের মধ্যে গাছ লাগানো কর্মসূচিকে আরও বেগবান করে তুলতে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে সচেতন মহলের। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমে স্থানীয় ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিক ও দরিদ্র বেকার যুবক সম্প্রদায়কে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাদের জন্য বন থেকে প্রাপ্ত সুফল ভোগ করার সুযোগ রাখলে তারা আগ্রহের সঙ্গেই এ কাজে সম্পৃক্ত হবে। আমাদের স্বার্থে, আমাদের বাঁচার তাগিদে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টায় এ লক্ষ্য অর্জন করা খুব কঠিন নয়। তাই আসুন আমরা পরিবেশ রক্ষার্থে, আমাদের জীবন বাঁচাতে বনজ সম্পদ রক্ষা করি। প্রাকৃতিক বন ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সরকার এবং এলাকাবাসীকে সম্মিলিত প্রয়াস চালাতে হবে। বন ব্যবস্থাপনায় বননির্ভর মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বন বিভাগের সাথে সাধারণ মানুষের দূরত্ব কমাতে হবে।
গতকাল রবিবার রাঙামাটি জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ইউএনডিপি সিএইচটিডিএফ এর সহায়তা প্রকল্পের পার্বত্য চট্টগ্রামের বন ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ শীর্ষক আঞ্চলিক কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
ইউএনডিএফ সিএইচটিডিএফের উপ-পরিচালক প্রসেনজিৎ চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় বক্তব্য রাখেন রাজা ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায়, মং সার্কেলের প্রধান সাচিং প্রু চৌধুরী, বন সংরক্ষক মো. সামশুল আজম, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গুণেন্দু বিকাশ চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি গৌতম দেওয়ান, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সাধনমণি চাকমা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সিয়ং ইয়ং ম্রো, আইইউসিএনের পরিচালক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ, আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইউএনডিপি-সিএইচটিডিএফ প্রকল্পের জনগোষ্ঠী ক্ষমতায়ন প্রকল্পের প্রধান বিপ্লব চাকমা। রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, জনগণের অংশীদারিত্ব ছাড়া আইন, বন্দুক, বনপ্রহরী দিয়ে বনরক্ষা করা যায় না। বন রক্ষার নামে অনেক মামলা হয়েছে কিন্তু বন রক্ষা করা যায়নি।
সাবেক প্রধান বনসংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আলাদা বৈশিষ্ট্য হল এখানে প্রাকৃতিক বন আছে। এখানে জীব বৈচিত্র্য বিদ্যমান। কিন্তু তা হারিয়ে যাবে তা ভাবতে কষ্ট হয়।
কমিটি সিএইচটিডিএফকে দায়িত্ব দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ আঞ্চলিক পর্যায়ের কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে।
বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণি, কীটপতঙ্গ, অণুজীব, মাটি, পানি, বাতাস এবং অন্যান্য জড় পদার্থের সম্মিলনে পৃথিবীর প্রাতিবেশিক অবস্থা বা বাস্তুসংস্থান সৃষ্টি হয়। আমরা খালি চোখে দেখি আর না-ই দেখি, এই প্রাতিবেশিক অবস্থা মানবসভ্যতার উন্নয়ন বজায় রাখার জন্য অনেকাংশে ভূমিকা পালন করেছে। এ অবস্থাগুলোই পৃথিবীর সমগ্র প্রকৃতি প্রকাশ করে। এটি এখন সর্বজনগৃহীত যে, পৃথিবীর যতটুকু টেকসই উৎপাদন ক্ষমতা আছে, তার থেকে অনেক বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষ ভোগ করছে। অনেক বাস্তুসংস্থান তাই এখন কঠিন বিপর্যয়ের মুখে আছে, যা আগের অবস্থায় আর কখনও ফিরে যাবে না। জনংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের অপরিণামদর্শী আচরণ এর জন্য দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। প্রত্যেক মানুষের গড়ে ২.৭ গ্লোবাল হেক্টরের মাটি ও পানির চাহিদা রয়েছে। যেখানে পৃথিবীর উৎপাদনশীল মাটি ও পানির যোগান হচ্ছে ২.১ গ্লোবাল হেক্টর। তার মানে, এখনই পৃথিবীর উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় আমরা ৩০ শতাংশ সম্পদ বেশি ব্যবহার করছি। পৃথিবীর অনেক বাস্তুসংস্থান এখন কঠিন বিপর্যয়ের মুখে আছে, যা আগের অবস্থায় আর কখনও ফিরে যাবে না পৃথিবীর অনেক বাস্তুসংস্থান এখন কঠিন বিপর্যয়ের মুখে আছে, যা আগের অবস্থায় আর কখনও ফিরে যাবে না ওদিকে, ২০০৭ সালের হিসাব মতে, বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের গড় চাহিদা হচ্ছে ০.৬২ গ্লোবাল হেক্টর। যেখানে উৎপাদন ক্ষমতা হচ্ছে মাত্র ০.৩৮ গ্লোবাল হেক্টর। যার মানে দাঁড়ায়, বাংলাদেশের বাস্তুসংস্থান আনেক আগেই টেকসই উৎপাদনশীলতা হারিয়েছে। পৃথিবীর বর্তমান ভোগ ও উৎপাদন ক্ষমতার ধারা যদি বজায় থাকে, তাহলে ২০৫০ সাল নাগাদ ৯.৬ বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটানোর জন্য বর্তমান পৃথিবীর সমান মোট তিনটি পৃথিবীর প্রয়োজন পড়বে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ রকম উৎপাদনশীল তিনটি পৃথিবীর মতো গ্রহ পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাহলে পৃথিবীর সম্পদ-উৎপাদনের প্রাকৃতিক যে ক্ষমতা আছে, এর মধ্য থেকেই আমাদের সতর্ক হয়ে চলার বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষমতা বিঘ্নিত করতে না পারে। তাই এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম হচ্ছে, ‘‘ঝবাবহ নরষষরড়হ ফৎবধসং. ঙহব ঢ়ষধহবঃ. ঈড়হংঁসব রিঃয পধৎব.” — বাংলায় মোটামুটি এ রকম বলা যায়, ‘‘শত শত কোটি মানুষের জীবন ও স্বপ্ন হচ্ছে একটি গ্রহ নিয়েই, তাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।’’ আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতি ও পৃথিবীর প্রাকৃতিক সুস্বাস্থ্য পরস্পরেরর সঙ্গে অপরিহার্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সর্বত্র আজ ডাক উঠেছে ক্ষয়শীল প্রকৃতি পুনর্জীবিত করার; কারণ তা না হলে বৈশ্বিক অর্থনীতির সুস্থতাও হারাতে হবে। আজকের প্রকট বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি যে কারণেই সৃষ্টি হোক না কেন, এটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রকৃতির সুস্থতা যে মহৌষধ হিসেবে কাজ করবে, সে বিশ্লেষণ অনেকেই করছেন। পৃথিবীর প্রকৃতিস্থতা রক্ষার জন্য বনের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু বনের ক্রমবর্ধমান ক্ষয় তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নষ্ট করছে। পৃথিবীতে এখনও প্রায় চার বিলিয়ন হেক্টর বন টিকে আছে। সুতরাং বৈশ্বিক অর্থনীতি সুস্থ রাখার জন্য এই বন যে কোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখতে হবে। হারিয়ে যাওয়া বনভূমিও ফিরিয়ে আনতে হবে বন্য আবহে।
পৃথিবীতে এখনও প্রায় চার বিলিয়ন হেক্টর বন টিকে আছে
একটি তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬.৭৭ বিলিয়ন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সর্বোচ্চ হার ১৯৬২-১৯৬৩ সালে বার্ষিক ২.২ শতাংশ হলেও ২০০৭ সালে তা ১.১৯ শতাংশে এসে পৌঁছেছে। তা সত্ত্বেও ২০৫০ পর্যন্ত পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে বলে জনসংখ্যা বিশারদদের ধারণা। তাদের হিসাবে ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই জনসংখ্যা প্রায় ৯.৬ বিলিয়নে পৌঁছাবে। পৃথিবীর সর্বত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও ঘনত্ব সমান নয়। মহাদেশ হিসাবে মোট জনসংখ্যা ও ঘনত্বের বিচারে এশিয়া সবচেয়ে জনবহুল। বাংলাদেশ শুধু এশিয়াতেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জনবহুল। বর্তমানে এর মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১৫,৫৬,৮৮,৬৬০ জন। আর প্রতি বর্গ কিলোমিটারে এখানে প্রায় ১,০৫৫ জন বাস করে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা প্রতিনিয়তই তাদের নিজস্ব প্রয়োজনে প্রাকৃতিক বন ও সৃজিত বনের উপর কাষ্ঠল ও অকাষ্ঠল দ্রব্য সংগ্রহের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করছে। শুধু তাই নয়, অধিক জনসংখ্যার জন্য অধিক বসতবাটি নির্মাণ, অধিক খাদ্যের প্রয়োজন মিটানোর জন্য কৃষিক্ষেত্রের বিস্তার ও শিল্প স্থাপনার জন্য বনভূমির আকার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। এই চাপ কমানো না গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অতি বৃষ্টিপাতে মাটিক্ষয়, বন্যা, বৃষ্টিপাতের পুনরাবর্তন এবং ভূত্বকের অভ্যন্তরে পানির সঞ্চয়ের ক্রমহ্রাসমানতার উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশেষ করে বনে বার্ষিক উৎপাদিত বনজদ্রব্যের পরিমাণের চেয়ে বেশি মাত্রায় বন থেকে এর সংগ্রহই বনের অব্যাহত উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত করছে। বনের ক্ষয়ও হচ্ছে মূলত এ জন্যই। শিল্পোন্নত দেশে কাঠের ব্যবহার হচ্ছে কাগজ উৎপাদনের জন্য, আর গরিব দেশগুলোতে জ্বালানি হিসাবে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেই মোট শক্তি ব্যবহারের অর্ধেকেরও বেশি জৈব জ্বালানি থেকে আসে। আর তা গ্রামীণ এলাকায় শতকরা প্রায় ৯০ শতাংশ। জৈব জ্বালানির বেশিরভাগই আসে গৃহস্থালি বন ও কৃষিক্ষেত্র থেকে। এর মধ্যে গৃহস্থালি বন থেকে উদ্ভূত জৈব জ্বালানির ব্যবহার সর্বোচ্চ। সেখানে আবার জ্বালানি কাঠের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। গ্রামীণ এলাকায় যত জৈব জ্বালানি ব্যবহার করা হয়, তার প্রায় ৯০ শতাংশই রান্নাবান্নার জন্য। রান্নায় যেসব চুলা ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশিরভাগই কম দক্ষতাসম্পন্ন। যার ফলে জ্বালানি কাঠের ব্যবহার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
কাঠের এসব ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার যে অন্তর্নিহিত দক্ষতা প্রত্যেক দেশের আছে, তা যদি কাজে লাগানো যায়, তাহলে বনের ক্ষয় অবশ্যই আটকানো সম্ভব। কাগজ পুনরাবর্তনের মাত্রা বিভিন্ন উন্নত দেশে বিভিন্ন রকম। ওয়াশিংটনের আর্থ পলিসি ইনস্টিটিউটের খধংঃবৎ জ. ইৎড়হিএর তথ্যমতে, সবচেয়ে বেশি কাগজ উৎপাদনকারী প্রথম দশটি দেশের মধ্যে চীন ও ফিনল্যান্ড যথাক্রমে ৩৩ ও ৩৮ শতাংশ কাগজ পুনরাবর্তন করে। অথচ দক্ষিণ কোরিয়া ও জার্মানিতে এ হার যথাক্রমে ৭৭ এবং ৬৬ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বোচ্চ কাগজ ব্যবহারকারী হলেও কাগজের পুনরাবর্তনের মাত্রা দক্ষিণ কোরিয়ার চেয়ে অনেক কম। দক্ষিণ কোরিয়া যে মাত্রায় কাগজের পুনরাবর্তন করছে, সে মাত্রায় যদি পৃথিবীর প্রত্যেক দেশ করে, তাহলে মণ্ডের প্রয়োজন এক তৃতীয়াংশ কমে যেত। তাতে বনের উপর নির্ভরশীলতাও অনেকাংশে কমবে। কাগজের ব্যবহার কমানোর জন্য কতগুলি কৌশল অবলম্বন করা যায়। বিশ শতকে কাগজ ব্যবহারের একটি বিশেষ দিক আমরা বিশ্লষেণ করলে খুঁজে পাই; তা হচ্ছে, কাগজজাত দ্রব্য একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া এবং তা পুনরাবর্তন না করা। একবার ব্যবহারযোগ্য কাগজজাত দ্রব্য ব্যবহার না করে বিকল্প দ্রব্য ব্যবহার করা হলে কাগজের ব্যবহার অনেকাংশে কমবে। যেমন, ফেসিয়াল টিস্যু, কাগজের ন্যাপকিন, শিশুদের ডায়াপার, কাগজের শপিং ব্যাগ ব্যবহার না করে পুনঃব্যবহারযোগ্য কাপড় পরতে পারি। বনজদ্রব্য ব্যবহারে পরিবর্তনের ধারণাই হয়তো বনরক্ষায় যথেষ্ট নয়। পৃথিবীর যেসব দেশে বেশি বেশি বন ধ্বংস হচ্ছে, যেমন বাংলাদেশসহ চীন, ফিলিপিন্স ইত্যাদি দেশে আইনের মাধ্যমে বন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এ পর্যন্ত আইন প্রয়োগ করে প্রায় ২৯০ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমির কাঠ কাটা বন্ধ করা গেছে।
বিভিন্ন দেশে গৃহীত সরকারি নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন ও পরিবেশ বিষয়ক এবং আর্থিক সংস্থাগুলো বনরক্ষায় এগিয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালে বিশ্ব ব্যাংক ডড়ৎষফ ডরফব ঋঁহফ ভড়ৎ ঘধঃঁৎব (ডডঋ)এর সঙ্গে জোট বেঁধেছে বিশ্বব্যাপী বনের টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য। তারা ২০০৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন দেশে ৫৫ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমি সংরক্ষিত ঘোষণা করতে সহযোগিতা করেছে। ২০০৫ সালের মাঝামাঝি তারা ঘোষণা দিয়েছে যে, ২০২০ সালের মধ্যে বনধ্বংস শূণ্যের কোটায় নিয়ে আসতে সব রকম সহযোগিতা করবে।
নতুন করে বনের সৃজন প্রাকৃতিক বনের উপর চাপ কমাতে পারে। ২০০৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে মোট সৃজিত বন ছিল ২০৫ মিলিয়ন হেক্টর। সৃজিত বনে বল্লি কাঠের (ঞরসনবৎ) উৎপাদন পৃথিবীব্যাপী বার্ষিক প্রায় ৪৩২ মিলিয়ন ঘন মিটার। যা সকল কাঠ উৎপাদনের ১২ শতাংশ। তাহলে বাকি ৮৮ শতাংশ নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক বন থেকে আহরিত হয়। ঋঅঙ (ঋড়ড়ফ ধহফ অমৎরপঁষঃঁৎব ঙৎমধহরুধঃরড়হ ড়ভ ঃযব টহরঃবফ ঘধঃরড়হং) ধারণা করে, ক্ষয়প্রাপ্ত বনভূমি অন্য কোনো কাজে ব্যবহার না করে শুধু সৃজিত বনের জন্য ব্যবহার করা হলে সৃজিত বনের এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। আর তাতে আগামী তিন দশকে দ্বিগুণেরও বেশি কাঠ আহরণ করা যাবে।
দক্ষিণ কোরিয়া বন পুনঃসৃজনের ক্ষেত্রে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। ৫৫ বছর আগে কোরিয়ার যুদ্ধ শেষ হলে দেশটির প্রায় সব বন ধ্বংস হয়ে যায়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং হিএর নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় কোরিয়ান সরকার বড় ধরনের বন পুনঃসৃজন কর্মসূচি হাতে নেয়। এতে গ্রামীণ সমবায় গঠনের মাধ্যমে হাজার হাজার লোক ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে গাছ লাগানো শুরু করে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৬৫ শতাংশ জায়গা বনে আবৃত। যা প্রায় ৬ মিলিয়ন হেক্টরের সমান। নতুন করে গাছ লাগানোর জন্য এখন সেখানে কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। অধিক দক্ষতাসম্পন্ন রান্নার চুলা ও রান্নার বিকল্প জ্বালানি, কাগজের বিজ্ঞানসম্মত পুনরাবর্তন, একবার ব্যবহারযোগ্য কাগজের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা পৃথিবীর বনের উপর চাপ কমাতে পারে বলেই এই নিবন্ধ মত প্রকাশ করে। পাশাপাশি নতুন বন সৃজন ও পূনঃসৃজন বনজদ্রব্যের চাহিদা মিটিয়েও প্রাকৃতিক বন সংরক্ষণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্যের পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে প্রত্যেক কর্মসূচিতে জনসাধারণকে জড়ানো না গেলে সাফল্য আসবে না। এ জন্য সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা দরকার। সবার উপর দরকার রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা। যা দেশকে পরিবেশবান্ধব হয়ে টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত করবে। এই পৃথিবী আমাদের । পুরো পৃথিবীটাই একটা গ্লোবাল ভিলেজ। এ গ্রামের বাসিন্দা যারা তাদের গ্রাম মায়ের সাবলীল পথ চলাকে অব্যহত রাখতে এর পরিবেশ রক্ষা করা জরুরী।। যাদের কর্মকাণ্ডের ফলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ছে, তাদেরকে শুধু দোষারোপ করে বসে থাকার সময় নেই। পৃথিবীর সব মানুষকে এখন দায়িত্বশীলতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। নিজের প্রয়োজনে ,ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রয়োজনে বনভুমি রক্ষা,বৃক্ষ তরুলতা কিংবা খাল বিল জলাশয় রক্ষা এখন সময়ের দাবী। বিশেষ করে আমাদের বাংলাদেশ তথা ঢাকা শহরকে বসবাসের যোগ্য রাখতে হলে এর চারপাশের বনভুমি বিশেষ করে গাজীপুরের বিশাল বনভুমি ও নারায়নগঞ্জ অঞ্চলের বিশাল জলাভুমি রক্ষা এখন সময়ের দাবী । তা না হলে ধেয়ে আসবে ধ্বংস , যা রক্ষা করার সাধ্য আমাদের নেই।।
https://www.facebook.com/gramechol/
(সম্পাদিত)
Personal Blog · 202 Likes
Grame chol গ্রামে চল's photo.
Grame chol গ্রামে চল